মিডিয়া চালাতে হবে হুমকি দিয়ে। ধমকে রাখতে হবে মিডিয়াকে। সব সরকারের আমলে কিছু মানুষ এমনই মনে করে। এই চিন্তা ভুল। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার পরদিন সকালে এনএসআই কর্মকর্তা মেজর লিয়াকত এসেছিলেন এটিএন বাংলা অফিসে। আমি ছিলাম বাসায়। এটিএন বাংলার তখনকার উপদেষ্টা সরকার ফিরোজ ফোন করলেন। বললেন, দ্রুত অফিসে আস। আগের রাত ছিল ঘুমহীন। তবু সকাল সকাল আবার অফিসে আসি। সরকার ফিরোজের রুমে প্রবেশ করতেই দেখি বসে আছেন এনএসআই কর্মকর্তা মেজর লিয়াকত। পরিচয় হলো। কোনো ভণিতা না করেই তিনি বললেন, গ্রেনেড হামলায় ধারণ করা সব ভিডিও ফুটেজের মূল কপি দিয়ে দিতে হবে। আমি বললাম কেন দেব? এগুলো ডকুমেন্টস। তিনি বললেন, রাষ্ট্রের নিরাপত্তার স্বার্থেই আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি সব টেলিভিশনের ধারণ করা ভিডিওর মূল ক্যাসেট নিয়ে নেব। বিস্ময় নিয়ে তাকালাম। বলে কী? আমি বললাম, মামলার তদন্তের স্বার্থে পুলিশকে আমরা ভিডিওর কপি দিতে পারি। মূল কপি কাউকে দেব না। কারণ এই ভিডিওর মাধ্যমে হামলাকারীকে চিহ্নিত করা সম্ভব। মেজর লিয়াকত আমার দিকে কঠোর দৃষ্টিতে তাকালেন। বললেন, আপনি সরকারি কাজে ডিস্টার্ব করছেন। আমিও পাল্টা অবস্থান নিলাম। পরিস্থিতি গুমোট হয়ে ওঠে। উত্তেজনা প্রশমন করতে সরকার ফিরোজ বললেন, আরেক কাপ কফি দেব কি? আমি বললাম, লিয়াকত সাহেব আমি আপনাকে ধারণ করা ফুটেজের কপি দিতে পারি, আপনি এটিএন বাংলা চেয়ারম্যান বরাবর আবেদনপত্র এনেছেন কি? তিনি বললেন আনিনি। তীব্র বিতণ্ডার পর মেজর লিয়াকত পিছু হটলেন। বললেন, আমি অফিসে যাচ্ছি। ফিরব আবেদন নিয়ে। আমি বললাম, আপনি না এলেও হবে। লোক পাঠালে দিয়ে দেব। লিয়াকত চলে গেলেন। আমার মাথায় কাজ করছিল না কী কারণে এই ফুটেজের মূল কপি এনএসআই নিয়ে যেতে চায়? কী অপার রহস্য। আমি তাত্ক্ষণিক পুরো ফুটেজের অনেকগুলো কপি করার নির্দেশ দিই। এর মাঝে ফোন করি মার্কিন দূতাবাসের আলী ভাইকে। পুরো ঘটনা জানালাম। তিনি ফোন দিলেন, জন চ্যাবরা নামের এক কর্মকর্তাকে। সব শুনে চ্যাবরা বললেন, আমরাও চিঠি দিয়ে আলীকে পাঠাচ্ছি। এর মাঝে পুরো ঘটনা জেনে গেলেন তখনকার বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা। তিনি সব শুনে আওলাদকে বললেন, আমাকে ফোনে ধরতে। আমার কাছে তিনি সব শুনলেন। বললেন, আমি সব টিভিতে লোক পাঠাচ্ছি। ওরা গ্রেনেড হামলার ডকুমেন্টস ধ্বংস করতে চায়। কারণ তারাই সব করিয়েছে। না হলে এই ফুটেজের মূল ক্যাসেট ধমক দিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করবে কেন। চিঠি নিয়ে এটিএন বাংলা অফিসে এলেন মার্কিন দূতাবাসের আলী ভাই (বর্তমান পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ভাই ও তখনকার মার্কিন দূতাবাসের প্রধান কর্মকর্তা)। কিছুক্ষণ পর এলেন আওয়ামী লীগের অসীম কুমার উকিল অথবা প্রেস সচিব আবুল কালাম আজাদ। কিন্তু এনএসআইর লিয়াকতের তখনো খবর নেই। সবাই ফুটেজের একটি করে কপি নিয়ে যাওয়ার পর তারা এলেন। আমাকে দেখে নেওয়ার হুমকি দিয়ে একটি কপি নিয়ে চলে গেলেন। আজও আমি সেই রহস্য নিয়ে ভাবী। কারণ ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা ও চট্টগ্রামের অস্ত্রের ট্রাক আটকের ঘটনায় সেই মেজর লিয়াকত তার বসদের সঙ্গে এখন কারান্তরীণ। তার বিরুদ্ধে প্রমাণ মিলেছে চট্টগ্রাম অস্ত্র রহস্যের।
মাঝে মাঝে মনে হয় রাজনীতিবিদরা ক্ষমতায় গেলে সব ভুলে যান। আবার ক্ষমতার গন্ধ পেলেই নিজেকে সামাল দিতে পারেন না। এখনো মাঝে মাঝে হুমকি পাই বিভিন্ন মহলের। কষ্ট হয়, দুঃখ হয়। মাঝে মাঝে মেজাজও খারাপ হয়। হামলা-মামলায় আমরা মিডিয়া কর্মীরা অভ্যস্ত হয়ে উঠছি। ২৭টি মামলা রয়েছে আমার বিরুদ্ধে। মামলাকারীদের মধ্যে ক্ষমতাবান এমপি রয়েছেন। কেউ কেউ সাবেক মন্ত্রী এই সরকারের। ক্ষমতাবানরা বুঝতে চান না, তিনি চিরস্থায়ী নন। কারও ক্ষমতাই চিরস্থায়ী নয়। আমাদেরও বয়স হয়েছে। এখন অনেকে ধমকের সুরে কথা বললে ভালো লাগে না। বিএনপি আমলে দাপুটে মন্ত্রী আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ মামলা করেছিলেন এটিএন বাংলার বার্তা সম্পাদক হিসেবে আমার ও রিপোর্টার ফারজানা রুপার বিরুদ্ধে। জটিল কোনো কিছু ছিল না। পুলিশের ভাষ্য নিয়েই রুপা রিপোর্ট করেছিল, বগুড়ায় অস্ত্র উদ্ধারের ঘটনায় আটক তিনজন জামায়াত কর্মী। পুলিশের ভাষ্য মুজাহিদ মানলেন না। তিনি মামলা করলেন। দুই শত পুলিশ পাঠিয়ে এটিএন বাংলা অফিসে আতঙ্ক তৈরি করলেন। রুপা ছিল অফিসের বাইরে। তাকে ফোন করে বললাম, অফিসে না আসতে। শ্রদ্ধেয় সাইফুল বারী আমাকে বললেন, অফিস ছেড়ে চলে যেতে। বার্তা বিভাগের দায়িত্ব আমার। আমি অফিস ছাড়লে একটা খারাপ দৃষ্টান্ত হবে। বিভিন্ন গণমাধ্যমে কর্মরত সাংবাদিক বন্ধুদের বিষয়টি জানালাম। পুলিশের হাবভাবে মনে হলো আটক হতে যাচ্ছি। ফোন করলাম বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনাকেও। তিনি বললেন, আটকের দরকার নেই। ওরা টর্চার করে এখন। তুমি পারলে অফিস ছেড়ে চলে যাও। এর মাঝে বিভিন্ন গণমাধ্যমের সাংবাদিক বন্ধুরা চলে এলেন। তেজগাঁও থানার ওসি ছিলেন তখন রুহুল আমীন। এসির নামটা মনে করতে পারছি না। এসি অফিসে আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করলেন। আমি তাকে বললাম, আমাকে কি আটক করবেন? ওসি বলল নির্দেশ তেমনই। আমি সময়ক্ষেপণ শুরু করলাম। তাদের বললাম, বিভিন্ন পত্রিকার সাংবাদিকরা বাইরে আছেন। তাদের কি ডাকতে পারি। ওসি ও এসি দুজনই মুখ চাওয়া-চাওয়ি করলেন। তারা আমাকে বললেন, আপনার প্রতি আমাদের সম্মান আছে। জামায়াতের মন্ত্রীর নির্দেশ মানতে আমাদেরও ভালো লাগছে না। কিছু মনে করবেন না। আমরা চাকরি করি। আমি বললাম যা করেছি পর্যাপ্ত ডকুমেন্টের ভিত্তিতে করা। পুলিশের ডিআইজির সাক্ষাৎকার আমাদের কাছে আছে। তিনি বলেছেন, আটকরা স্বীকার করেছে তারা জামায়াতের কর্মী। আমাদের রিপোর্টার রুপা ছাড়াও রাজশাহীর সুজা উদ্দিন ছোটন ও বগুড়া প্রতিনিধি রিপন সব ডকুমেন্টস অফিসে জমা দিয়েছেন। তাদের কাছ থেকে প্রাপ্ত ডকুমেন্টের ভিত্তিতেই এ রিপোর্ট সম্প্রচার করেছি।
এর মাঝে আমাদের সহকর্মীদের ভিড় বাড়তে থাকে। অন্য পত্রিকার লোকজনও আসতে থাকে। সবার মাঝে উত্তেজনা। পুলিশও ওপরে যোগাযোগ শুরু করে। পরিস্থিতি জানায়। বাসা থেকে ফরিদার উৎকণ্ঠা নিয়ে ফোন। চারদিকে ফোন করতে আমাকে পুলিশ বাধা দিচ্ছে না। এক ফাঁকে পুলিশ কর্মকর্তাদের আমি বললাম, আপনাদের কর্মকর্তাদের ধারণ করা সাক্ষাৎকার এবং আসামিদের ধারণ করা বক্তব্য সম্প্রচার হলে সবাই বিব্রত হবেন। একপর্যায়ে কর্মকর্তাদের কাছে নির্দেশ আসে, ফিরে এস। সাংবাদিকদের আটকের দরকার নেই।
আমাকে আটক না করেই পুলিশ ফেরত গেল। এরপর অনেক দিন এটিএন বাংলায় জামায়াতের সংবাদ বন্ধ ছিল। তবে এই বন্ধ থাকার নির্দেশ এটিএন চেয়ারম্যান মাহফুজুর রহমান নিজেই দিয়েছিলেন। আমি সব সময় তার প্রশংসা করি অনেক কারণে। তিনি অবাধে সংবাদ পরিবেশনে সাহস জোগাতেন। একবার তথ্যমন্ত্রী তরিকুল ইসলাম তাকে ডেকে বলেছিলেন, বার্তা বিভাগের দায়িত্ব থেকে আমাকে সরাতে। তিনি গুরুত্ব দেননি মন্ত্রীর নির্দেশ। এমনকি আমাকে সরানোর এনএসআইয়ের তখনকার দুই ডিজি আবদুর রহিম ও রেজ্জাকুলের মন্ত্রণাকেও তিনি পাত্তা দেননি। জীবন চলার পথে অনেক কিছু মোকাবিলা করেই আমাদের মিডিয়া চালাতে হয়। আমরা পথ চলি ঘটে যাওয়া তথ্যগুলো তুলে ধরার জন্য। কথা বললেই, চেহারা বদলে যায় সবার। বন্ধু হয়ে ওঠে পর। দেশ ও মানুষের কল্যাণে মিডিয়া চালানো সব সময়ই কঠিন। কারণ ক্ষমতায় থাকলে বাস্তবতা বুঝতে পারা যায় না। সবাই চায় নিজের মতো নিয়ন্ত্রণ। মানুষ আসলে ক্ষমতায় থাকলে এক বিরোধী দলে আরেক। ক্ষমতাসীন দলের গতি পরিবর্তনে বড় ভূমিকা আমলাদের। আর দল বিরোধী দলে থাকলে প্রভাব থাকে দলীয় কামলাদের। বাস্তবে অনেক দিন থেকে দেখে আসছি, রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় আসে দলীয় কামলাদের ওপর ভর করে। আর ক্ষমতা থেকে বিদায় নেয় প্রভাবশালী আমলাদের ওপর ভর করে। বিরোধী দলে থাকলে দলীয় কামলারাই সব। আর সরকারে থাকলে সব বিশ্বাস আস্থার প্রতীক হয়ে ওঠেন আমলারা। তাদের কথার বাইরে যাওয়ার সুযোগ থাকে না রাজনীতিবিদদের। রাজনীতিবিদদের এই পরিবর্তন কর্মীদের মনে একটা কষ্ট তৈরি করে। এই কষ্ট যখন ভয়াবহ রূপ নেয় তখন প্রকৃতি বৈরী হয়। এই বৈরী পরিবেশ ওয়ান-ইলেভেন নামিয়ে আনে। অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরী, কর্নেল (অব.) অলি আহমদদের কষ্টের খেসারতই বিএনপিকে এখন দিতে হচ্ছে।
ওয়ান-ইলেভেনের পর অনেক রাজনীতিবিদকে দেখতে যেতাম। আবদুল জলিলকে দেখে এসেছিলাম ল্যাবএইড হাসপাতালে। আরেকজন নেতাকে দেখতে গিয়েছিলাম পুরাতন ঢাকার কোর্ট কাচারিতে। পুলিশকে ম্যানেজ করে রেখেছিলেন সেই নেতা। আমরা যেতেই আদালতের উত্তর পাশের নিরাপত্তা বেষ্টনীর ভিতরে একটি ভ্যানের ভিতরে আমাকে নিয়ে যাওয়া হয়। ভ্যানে প্রবেশ করেই বিস্মিত হলাম। একসঙ্গে দুপুরের খাবার খাচ্ছেন সালমান এফ রহমান, আলী আসগর লবি, এম এইচ সেলিম বা সিলভার সেলিমসহ কয়েকজন বিএনপি ও আওয়ামী লীগের নেতা। সবাই খাবার ভাগাভাগি করছেন। গল্প করছেন। একই দৃশ্য দেখেছি গাজীপুরের কাসিমপুরে। সবাই একসঙ্গে আড্ডা দেন। রাতে টিভি দেখেন। মসজিদে নামাজ পড়েন। মোসাদ্দেক আলী ফালু দলমত নির্বিশেষে সবাইকে বলতেন, টাকা পয়সার সমস্যা থাকলে যেন তাকে বলে। আমি একদিন তাদের কয়েকজনকে বলেছিলাম, আগামীতে আপনাদের মাঝে অবশ্যই সুন্দর এমন একটা ঐক্য দেখব। তারা বলেছিলেন, সবাই মিলেমিশে দেশ চালাব। নেতাদের অনেকেই তখন আমাদের বলেছিলেন, আর রাজনীতিই করবেন না। একমাত্র সিলভার সেলিম কথা রেখেছেন। তিনি রাজনীতি থেকে বিদায় নিয়েছেন। এখন ব্যবসা-বাণিজ্য করেন। বাকি সবাই রাজনীতি করছেন। পরস্পর পরস্পরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছেন। হায়রে রাজনীতি! রাজনীতিবিদদের বদলে যাওয়া নিয়ে পুরাতন আরেকটি গল্প মনে পড়ছে। এরশাদের পতনের পরই আটক হলেন তার মন্ত্রী কাজী ফিরোজ রশীদ। মুক্তির পর তাকে দেখতে গিয়েছিলাম, তার ওয়ালসো টাওয়ারের বাসায়। ফিরোজ ভাই জেলখানার কষ্টের কথা বললেন। সাধারণ সেলে রাখা হয়েছিল তাকে প্রথম। একজন সাবেক মন্ত্রী হিসেবে ভিআইপি সেল পেতে সমস্যা হয়েছিল। কারাগারগুলোর সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা নিয়েও তিনি কথা বললেন। আমি তাকে বললাম কোনো দিন আবার ক্ষমতায় এলে জেল সংস্কার অবশ্যই করবেন। তিনি বললেন, ইতিহাস থেকে শিক্ষা না নেওয়াই হচ্ছে ইতিহাসের শিক্ষা। হয়তো একদিন আমিও ক্ষমতা পেয়ে একই আচরণ করব। ক্ষমতা বড় কঠিন। এখানে পুরনো দিনের কথা মনে থাকে না। দুঃসময়ের বন্ধুদের কথাও মনে থাকে না। তখন সামনে থাকা চাটুকাররাই আপন। আমলারা বলে, স্যার যা আছে তাই রাখুন। বদলানো যাবে না। তিনি আরও বলেছিলেন, ক্ষমতার চেয়ারটাকে নিয়েই বিপদ। মানুষ হিসেবে আমরা ঠিক থাকি। দোষ চেয়ারের। এই চেয়ারই আমাদের বদলে দেয়। সেদিন কথা বাড়াইনি। আজ আমার মনে হচ্ছে, সবই সত্য। জানি সত্য বড় কঠিন। এই কঠিন কারোরই ভালো লাগে না। শুধু চেয়ারে মানুষ বদলে যায় না, অনেক সময় ক্ষমতার গন্ধেই সব কিছু ওলট-পালট হয়ে যায়। কথায় আছে অনেকের নেশা হয়ে যায় শুধু গন্ধেই। বাস্তবেও যখন এমন দেখি তখন কষ্ট হয়। এই চিত্র দেখতে চাই না। দেখতে চাই একটি সুন্দর আগামী। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উন্নত সমৃদ্ধ বাংলাদেশ। আমাদের প্রত্যাশা বাংলাদেশ এগিয়ে চলছে, এগিয়ে চলুক।